নাহিদ ইসলাম

আমি চোখ খুললাম। অন্ধকার চারদিকে। পাশে একটা দেয়াল। আশেপাশে ঝোপঝাড়। মাটিতে পড়ে আছি। জ্ঞান ফেরার পর শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলাম। কিছুক্ষণ সময় লাগল ঠিক কী অবস্থায় আছি, কোথায় আছি বুঝতে। সামনে একটা ব্রিজের মতো দেখলাম। আশেপাশে কোনো বাড়িঘর নেই, কেবল ফ্লাইওভারের মতো একটা মহাসড়ক। আস্তে আস্তে গত ২৪ ঘণ্টার কথা মনে পড়ল। আমাকে তারা ফেলে রেখে গেছে কিংবা ছেড়ে দিয়েছে। হুম ছেড়ে দিয়েছে!

শেষ জিজ্ঞেসাবাদের সময় তারা বলছিল, ছেড়ে দেবে যদি আন্দোলন স্থগিত করি। আগামীকাল কোর্টের রায় দেবে কোটা সংস্কারের। রায় হলে যাতে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারকে ধন্যবাদ জানাই এবং বলি, ‘আন্দোলনে সরকারবিরোধীরা ঢুকে সব জায়গায় আগুন লাগিয়েছে এবং ছাত্র মেরেছে।’

আমি উঠে দাঁড়ালাম। বাঁ পায়ে ভর দিতেই কষ্ট হচ্ছে। প্যান্টের পকেটে এক হাজার টাকার একটা নোট পেলাম। সামনের মহাসড়কে উঠলাম। ভোর হচ্ছে। একটা সাইনবোর্ডে জলসিঁড়ি, পূর্বাচল ও কুড়িলের ডিরেকশন দেখলাম। আমি সোজা হাঁটতে থাকলাম। আশেপাশে কোনো গাড়ি নেই। কিছুক্ষণ পর আলো পুরোপুরি ফুটলে একটা সিএনজি পেলাম। বনশ্রী যেতে চাইল না। বললাম, আমাকে এই রাস্তার শেষ মাথায় নামিয়ে দেন যেখানে গাড়ি পাব। সিএনজি কুড়িল বা খিলখেতে রেললাইনের পাশে কোথাও এক জায়গায় নামিয়ে দিল। একটা দোকান থেকে মাস্ক কিনলাম। একটা ‘পাঠাও’ বাইক পেলাম। ঢাকা শহরের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখলাম। যেন এক ভয়াবহ যুদ্ধ ঘটে গেছে। বিভিন্ন জায়গায় পোড়া গাড়ি, ধোঁয়া ওঠা কয়লা, ভাঙা রাস্তা ও ব্যারিকেড। তেমন মানুষজন নেই, যানবাহন নেই। কয়েক জায়গায় বিজিবির লোকজন দেখলাম। ১৯ জুলাই রাতে আমাকে তুলে নেওয়ার আগে কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছিল। এখনো কারফিউ চলমান কি না জানি না। কী হচ্ছে না হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছিল, এ এক অচেনা পৃথিবী।

বাইক অনেক ঘুরে এলাকায় ঢুকল। বাসায় ঢোকার আগে অনেক খুঁজে কিছু পত্রিকা কিনলাম। তারা বলেছিল, আমার গুমের খবর কোথাও প্রকাশ পায়নি, পাবেও না। আন্দোলন সমাপ্তির ঘোষণা না দিলে তারা আবার তুলে নিয়ে আসবে সারাজীবনের জন্য। কিছু পত্রিকায় আমার নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ দেখলাম। কারফিউয়ের মধ্যেও বিক্ষোভ চলছে, আরও অনেক মানুষ মারা গেছে। বাসার মানুষ হাসপাতালে নিতে চাইলে গণস্বাস্থ্যে নিয়ে যেতে বললাম। চিকিৎসার চেয়েও সিকিউরিটি বেশি দরকার। গণস্বাস্থ্য ছাড়া আর কোনো নাম মাথায় এলো না।

গণস্বাস্থ্যে এসে গণ-অধিকার পরিষদের নেত্রী ফাতেমা আপার সঙ্গে দেখা হলো, জিল্লুর ভাই ফোন দিয়ে ভর্তি করে নিতে বললন। কিছুক্ষণ পর থেকে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন লোকজন আসা শুরু করলেন। হাসনাত, সার্জিস ও বৈষম্যবিরোধীর অন্য সমন্বয়করা এলো। রাতে একটা সংবাদ সম্মেলন করলাম হাসপাতালেই। গুম ও নির্যাতনের কথা বললাম। আসিফ, বাকের, কাদের ও রিফাতের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, শুনলাম।

রাতে একটা লোক এলো মাস্ক পরে। আয়নাঘরের জিজ্ঞেসাবাদে কী হয়েছে, জানতে চাইল। সব শুনে বলল, ‘তোমার সামনে দুটা রাস্তা আছে—এক. এসব ঘটনার মামলার আসামি হবা এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য জেলে থাকবা। অথবা হাইডে গিয়ে আন্দোলন পরিচালনা করবা।’ আমি বললাম, ‘প্রথমটা বেটার। ১৯ তারিখই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, প্রকাশ্যে থাকব। কাউকে না কাউকে তো পাবলিক থাকতে হবে। অন্যরা হাইডে থাকুক। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলে জানায়ও।’ তিনি বলে চলে গেলেন।

পরদিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পুলিশ ঝামেলা করার চেষ্টা করছে শুনলাম। আমার নাম অফিশিয়ালি কেটে দিয়ে সবাইকে জানানো হলো, রিলিজ হয়ে গেছে। সাততলায় গাইনি বিভাগের একটা কেবিনে আমাকে গোপনে রাখা হলো। কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না তখন, তাই এই ব্যবস্থা। অসুস্থ অবস্থায় আর কোনো ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে বলে মনে করলাম না। পরদিন রাতে ১২টায় নিচতলায় যখন এক্সরে করতে গেলাম, এক্সরে রুমে ডিজিএফআই’র কিছু অফিসার জোর করে ঢুকে পড়লেন; বললেন, কথা বলতে চান। আমি ডাক্তার-নার্সদের বের হয়ে যেতে বললাম। তারা পরিচিত আন্দোলনের সময় থেকে। আমার গুমের ঘটনা তারা স্বীকার করলেন না; বললেন, অন্য একটা এজেন্সি এটা করেছে। সরকারের নাকি এমন অনেকগুলা এজেন্সি আছে, যারা দমন-পীড়নের কাজ করে সরকারকে খুশি করার প্রতিযোগিতা করে। তারা তেমন না, তারা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে চায়। অন্যরা হয়তো বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান করতে চেয়েছে। আরও বললেন, অন্য সমন্বয়কদের পেতে হলে নাকি আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দিতে হবে। মেট্রোরেল ও বিটিভিতে আগুন ও নাশকতার জন্য অসংখ্য মামলা হবে আমাদের নামে। হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন, কোটা সংস্কারের। আমাদের দাবি পূরণ হয়ে গেছে। এখন যা চলছে, সব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। আন্দোলন উইথড্র না করলে আমাদের এই দেশে আর বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। পরদিন একটা প্রেস ব্রিফিং করতে বললেন। সরকার প্রজ্ঞাপন দেবে। আমার সব নিরাপত্তা তারা দেবে বললেন। আমাকে ভবিষ্যতেও রাজনৈতিকভাবে সব সহযোগিতা করবে বললেন। আমি বললাম, প্রেস ব্রিফিং করব।

২৩ জুলাই প্রেস ব্রিফিং হবে বিকালে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই রুমে সেই অফিসারকে দেখলাম। তিনি কিছুতেই পিছু ছাড়ছেন না। প্রেস ব্রিফিংয়ে কী বলতে হবে, ভালো করে বুঝিয়ে বললেন। আমি তাকে আবার আশ্বস্ত করলাম। দুপুরে যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলাম, সবাইকেই আসতে বললাম। মাহফুজ ভাই দুপুরে এলেন। একটা চিরকুট দিয়ে গেলেন পরবর্তী পরিকল্পনার। নাসির ভাই ও নিভা আপু পরশু থেকেই আছেন সঙ্গে। হাসিব ও শুভকে ডিআরইউতে সংবাদ সম্মেলন করার ব্যবস্থা করতে বললাম। সবাইকে হাসপাতাল থেকে ডিআরইউতে যেতে বললাম। আমার যেতে দেরি হচ্ছে দেখে ডিজিএফআই’র সেই অফিসারকে উদ্বিগ্ন দেখাল, বললেন, ‘তুমি যাচ্ছ না? তোমাকে যেতেই হবে।’ নাসির ভাইকে নিয়ে ডিজিএফআই’র মাইক্রোতে উঠে ডিআরইউতে গেলাম। লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরেই যেতে হলো। ডিআরইউ’র চারদিকে প্রচুর পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সদস্যরা।

কয়েকটা পৃষ্ঠায় আমি একটা বড় বক্তব্য লিখে গিয়েছিলাম। আন্দোলনে এর আগে কখনো লিখিত বক্তব্য পাঠ করিনি। কিন্তু সেদিন প্রতিটা শব্দ গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমার জন্য। আর মিডিয়ায় সব ভুলভাল বলা হচ্ছিল সে সময়। কী বলতে কী বলে ফেলি, তাই আগেই লিখে রাখছিলাম। আসিফের বাবাও এলেন প্রেস ব্রিফিংয়ে। তখনো ইন্টারনেট আসেনি।

বক্তব্য পাঠ করলাম। সরকারের প্রজ্ঞাপনকে অনেক ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে অস্বীকার করলাম। হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে বললাম, ‘এটা স্পষ্ট সরকারের দায়িত্বহীন আচরণ এবং দমন-পীড়ন নীতির জন্য এই অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এ দায় সম্পূর্ণ সরকারের। সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও জনজীবনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন সমগ্র পরিস্থিতির দায় শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ওপর চাপিয়ে সরকার আবার দায় এড়াচ্ছে।’

‘গত কয়েক সপ্তাহে রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতিতে সারাদেশে কয়েকশ ছাত্র-নাগরিক শহীদ হয়েছেন এবং কয়েক হাজার লোক আহত হয়েছেন। হতাহতের সঠিক সংখ্যা এখনো পাওয়া যায়নি। অনেক বাবা এখনো সন্তানের লাশ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এত রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা কোটা সংস্কার চাইনি। আমরা সব হতাহতের বিচার চাই। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, সারাদেশে যত মানুষ শহীদ হয়েছে, আহত হয়েছে, আমরা তাদের পাশে আছি এবং শেষ পর্যন্ত থাকব।’

রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের নির্বিচারে গ্রেফতারের নিন্দা জানালাম। এ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে শেষ করলাম। হাসপাতালে এসে আমি কর্মসূচি স্থগিত করেছিলাম, প্রেস ব্রিফিং থেকে আমরা আরও ৪৮ ঘণ্টা আল্টিমেটাম দিলাম। আট দফা না ৯ দফা নিয়ে বিভক্তি চলছিল। ১৯ তারিখ বিকালেই কাদের ৯ দফার কথা ফোনে বলেছিলেন। আমরা ইন্টারনেট ও ক্যাম্পাস খোলাসহ জরুরি চার দফার কথা বললাম। আসিফের বাবাও ছেলের সন্ধান চাইলেন। তিনি তখন মর্গে মর্গে ছেলের লাশ খুঁজছিলেন। এক বীভৎস পরিস্থিতি!

প্রেস ব্রিফিং ঠিকমতো শেষ করা গেল না। মাইক বন্ধ করে দেওয়া হলো। কারফিউ ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। প্রেস ব্রিফিংয়ের পর হাসপাতালে আর ফেরত আসতে পারব কি না জানতাম না। কিন্তু ওই গাড়িতেই আবার হাসপাতালে দিয়ে গেল। রাতে ৮টার দিকে সেই অফিসার ফোন করে অনেক হুমকি-ধমকি দিলেন। বললেন, সরকারের সব পরিকল্পনা নাকি আমি নষ্ট করে দিয়েছি। আমার সিকিউরিটি তারা আর দেবেন না। কী জানি কীসের সিকিউরিটি দিচ্ছিলেন তারা! একটা মেসেজ দিলেন—‘You are not in a position to give time to government. You are totally an ungrateful person.’

এই প্রেস ব্রিফিং খুব একটা প্রচারিত হলো না মিডিয়াতে। তবে পরদিন আসিফ আর বাকেরকে পাওয়া গেল। তাদেরও তুলে নিয়ে গিয়েছিল। রিফাতেরও সন্ধান পাওয়া গেল, সে নিজেই লুকিয়ে ছিল। আসিফ ও বাকের দ্বিতীয় তলায় একটা কেবিনে ভর্তি হলো। আসিফ-বাকের ফেরায় স্বস্তি ফিরে পেলাম। আমরা নতুন করে আবারও পরিকল্পনা ও যোগাযোগ করতে শুরু করলাম। রিফাত, মাহিন, মাসুদ, আরিফ সোহেল, নুসরাত, আশরেফা, অদিতি, অয়নসহ অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ সম্ভব হলো। জুনিয়রদের বললাম, আবার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। আমরা সম্পূর্ণ টার্গেটেড, এখন সামনে আসতে পারব না হয়তো। কিন্তু আন্দোলন তো চালিয়ে যেতে হবে।

গণস্বাস্থ্য কিছুটা সময়ের জন্য আমাদের একটা দুর্গ হয়ে উঠছিল। প্রেস ব্রিফিং, সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ, অন্য সবার সঙ্গে যোগাযোগ—সব এখান থেকেই হতো। কিন্তু এটা বেশিক্ষণ সম্ভব হয়ে উঠল না। সরকার টের পাওয়ার পর পুরো হাসপাতাল নজরদারির মধ্যে চলে যায়। হাসপাতালে সবার মধ্যে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া হয়। আমরা আর রুম থেকে বের হতে পারি না। রুমের সামনে পাঁচ-ছয়জন করে এজেন্সির লোক। সারাদিন বিভিন্ন সংস্থার অফিসাররা আসা শুরু করলেন। পরে শুনেছি ডাক্তার ও নার্সদেরও অনেক হয়রানি করা হয়েছে। আমার ট্রিটমেন্ট করেছেন, এরকম এক জুনিয়র ডাক্তারকেও তুলে নিয়ে গিয়ে মারধর করেছিলেন তারা।

একপর্যায়ে টেলিফোন, টেলিভিশন ও ইন্টারনেট লাইন সব কেটে দিল। ২৫ তারিখ রাতে অনেক ধ্বস্তাধস্তি করে দোতলায় আসিফদের রুমে ১০ মিনিটের জন্য যেতে পেরেছিলাম। ২৬ তারিখ দুপুরে পত্রিকা কিনতে পাঠালাম। পত্রিকা রুমে ঢুকতে দিল না। গণস্বাস্থ্যের শিরিন আপা এসে অনেক তর্কবিতর্ক করলেন পুলিশের সঙ্গে। এরপর ডিজিএফআই’র এক অফিসার এসে ধস্তাধস্তি করে মোবাইল কেড়ে নিলেন। ঘণ্টাখানেক পরে সিভিল ড্রেসে এক অফিসার এসে বললেন, তার সঙ্গে নিচে যেতে। বুঝলাম, চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। দোতলায় এসে দেখি আসিফ ও বাকের ধ্বস্তাধস্তি করছে কয়েকজন অফিসারের সঙ্গে। নার্স আপারাও অনেক বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবুও আমাদের হাসপাতাল থেকে বের করে নিয়ে গেল সরকারি বাহিনী।

পরে তিনজনকে একসঙ্গে একটা মাইক্রোতে উঠিয়ে নিয়ে গেল। কোনোরকম বিল পরিশোধ না করেই আমরা গণস্বাস্থ্য ত্যাগ করে ঢাকা শহরের সুপিরিচিত মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে প্রবেশ করলাম।

– আমার দেশ